কালের খবরঃ
দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলা গোপালগঞ্জ।এই জেলার অধিকাংশ মানুষের জীবীকা কৃষি ও মৎস্য চাষের উপর। সম্প্রতি গোপালগঞ্জের বিভিন্ন বিল বা জলাশয়ে জলাবদ্ধতা ও লবনাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে জেলার হাজার হাজার কৃষক ও মৎস্যজীবীরা। এসব সমস্যা সমাধানে গোপালগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড লাখ লাখ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে পূর্ব গোপালগঞ্জ সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া , কোটালীপাড়া ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার প্রায় ৭ লাখ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড ধারনা করছে।
চারমাস আগে প্রকল্পের ডিপিপি পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে পাঠালেও তা এখনও অনুমোদন পায়নি। যে কারনে গোপালগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাতে নেওয়া এ প্রকল্পে জেলার তিন উপজেলার ৬৫ হাজার হেক্টর আবাদী জমি এখনো সেচ সুবিধাসহ বন্যা ও লবণাক্ততার হাত হতে রক্ষা পেতে শংঙ্কার মধ্যে রয়েছে।
এ কারনেই এই এলাকার জমির পানি নিষ্কাশন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও সেচ সুবিধা প্রদান করে কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা, লবণ পানির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা, নৌ-চলাচল ও ফসল পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি কারার জন্য পূর্ব গোপালগঞ্জ সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে দ্রুত অনুমোদন করে বাস্তবায়নের দাবী জানিয়েছে এলাকাবাসী।
গোপালগঞ্জ পানি উন্নয়ন অফিস সূত্রে জানাগেছে, ৫শ’ ৫২ দশমিক ৬৫ কিঃমিঃ খাল পুনঃ খনন, বর্ণি বাওড় ৬ দশমিক ৯৯ কি:মি: ড্রেজিং এবং ১২ টি বোটপাস নির্মাণ। এই গুলেঅ বাস্তবায়িত হলে প্রকল্প এলাকায় লবন পানি নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি নিবিঘ্নে নৌকা চলাচল নিশ্চিত হবে, বর্ণি বাওড়ের চারপাশ সৌন্দর্য বর্ধন ও পর্যটন সুবিধার উন্নয়ন হবে এবং ১ দশমিক ৬শ’ কিঃমিঃ নদী তীর সংরক্ষণ কাজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নদী ভাঙ্গন রোধকল্পে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।
সূত্রে আরো জানা, ৫শ’ ৭৪ কোটি ২১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ব্যয়ে পহেলা ফেব্রুয়ারী ২০২৩ শুরু করে ৩০ জুন ২০২৫ তারিখে সমাপ্তি নির্ধারন করা হয় প্রস্তাবিত প্রকল্পে । প্রকল্প এরিয়ায় মোট জমির পরিমাণ ৮৮ হাজার ১শ” ২৭ হেক্টরের মধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৬৫ হাজার ৫শ’ ৭১ হেক্টর। এই তিন উপজেলার প্রকল্প এলাকায় ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৪শ’ ২১ জন লোক বাস করে। তাদের অধিকাংশই কৃষিজীবী, শ্রমজীবী ও মৎস্যজীবী এ এলাকার জনগণের প্রধান আয়ের উৎস্য কৃষি ফসল ও মৎস্য চাষ। এলাকার প্রধান ফসল ধান, পাট, তৈলবীজ, ডাল, গম ও শাক-সবজি।পিছিয়ে পড়া বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর বিষয় বিবেচনায় রেখে গোপালগঞ্জ সদর, টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়া উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।
প্রকল্প এলাকা হচ্ছে মধুমতি, বাঘিয়ারকূল, শৈলদাহ, ঘাঘর নদী এবং এমবিআর চ্যানেলের অববাহিকায় অবস্থিত। প্রকল্পের দক্ষিণ ও পশ্চিমে মধুমতি নদী, পূর্ব ও উত্তরে ঘাঘর ও শৈলদাহ নদী, উত্তরে কুমার নদ এবং পশ্চিম-উত্তরে এমবিআর চ্যানেল। উক্ত নদী গুলি অসংখ্য ছোট নদী, খাল দ্বারা সংযুক্ত। গড়াই নদী বড়দিয়া নামক স্থানে দুটি স্রোত ধারায় বিভক্ত হয়েছে, একটি নবগঙ্গা এবং অন্যটি মধুমতি নদী নামে পরিচিত। কুমার নদ ফরিদপুরে পদ্মা নদী হতে উৎপত্তি হয়ে ফরিদপুর সদর, নগরকান্দা, ভাংগা ও মুকসুদপুর উপজেলার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। মুকসুদপুর উপজেলায় সিন্দিয়াঘাট নামক স্থানে এমবিআর চ্যানেলের সংগে মিলিত হয়েছে। মাদারীপুর বিল রুট চ্যানেলটি নৌ-চলাচল সুবিধার জন্য বৃটিশ শাসন আমলে খনন করা হয়েছিল যা আড়িয়াল খাঁ নদী এবং মধুমতি নদীর সংযোগ করেছে। ঘাঘর নদী আড়িয়াল খা নদী হতে উৎপত্তি হয়ে বাঘিয়ারকূল ও শৈলদাহ নদীর মাধ্যমে মধুমতি নদীতে পড়েছে।
এই অঞ্চলের মূল প্রবাহ মধুমতি ও ঘাঘর নদীর অববাহিকার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল টুঙ্গিপাড়া, কোটালিপাড়া ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা অন্তর্ভুক্ত। কুমার নদের অববাহিকা মুকসুদপুর উপজেলা এবং ঘাঘর নদী কোটালীপাড়ার নিম্নাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। প্রকল্প এলাকায় মধুমতি নদী হতে একাধিক শাখা নদী, উপনদী, প্রধান খাল যথাক্রমে বাঘিয়াকূল, ঘাঘর, চাটখালী, শৈলদাহ নদী, মাদারীপুর-বিলরুট চ্যানেল, বরিনতি খাল ও সিলনা খালসহ অন্যান্য খাল প্রবহমান রয়েছে। কুমার নদ হতে প্রধান প্রধান বলুগ্রাম-তেতুলিয়া খাল, তালতলা-হাতিয়ারা খাল, মহারাজপুর খাল, বানিয়ার খাল এবং বাসারতের খালগুলো মাদারীপুর বিলরুট চ্যানেলের সাথে মিলিত হয়েছে। প্রকল্প এলাকার প্রধান বাওড়, বিলগুলো হলো টুঙ্গিপাড়ার বর্ণি বাওড়, সোনাখালি বিল, সদর উপজেলার কাজুলিয়া বিল, তেলিগাতি-গুয়াধানা বিল ইত্যাদি। এছাড়াও গোপালগঞ্জ জেলার অসংখ্য ছোট ছোট খাল ও বিল দ্বারা বেষ্টিত। বিল, বাওড়ের পানি অসংখ্য খালের মাধ্যমে নদীর সাথে সংযুক্ত হয়ে নিষ্কাশিত হয়। জেলার সকল খাল উল্লিখিত নদীগুলোর সাথে সংযুক্ত।
আরো জানাযায়, প্রকল্প এলাকাটি খুবই নিম্নাঞ্চল হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে পানিতে ডুবন্ত থাকে। ফলে বর্ষা মৌসুমে উঁচু স্থান ব্যতিরেকে কৃষি ফসল উৎপন্ন হয় না। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে সেচ কাজ ব্যাহত হয়। আবার নিষ্কাশন ব্যবস্থা কার্যকরী না থাকার কারণে প্রকল্প এলাকায় সময়মত ইরি বরো ধান রোপন করা যায়না। এলাকাটি নিম্নাঞ্চল বিধায় আগাম বর্ষাকালীন বৃষ্টিপাত জনিত কারণে প্রায় প্রতি বছর আকস্মিক বন্যায় ও সমুদ্রের জোয়ার ভাটায় লোনা পানি এলাকায় প্রবেশসহ নদী ভাঙ্গনে ব্যাপক ফসল হানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। মধুমতি নদী হতে প্রবাহিত শাখা নদী, উপনদী, প্রধান খালে বন্যার পানি ও জোয়ার ভাটার সাথে বিপুল পরিমাণ পলি পাউবো পোল্ডারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সংযোগ খাল, নালায় প্রবেশ করার ফলে এগুলোর ধারণ ক্ষমতা ও নৌ চলাচল বহুলাংশে হ্রাস পায়। ফলে পোল্ডার এলাকায় দীর্ঘ মেয়াদী জলাবদ্ধতা সৃষ্টিসহ বর্ষাত্তোর আবাদি জমি চাষ উপযোগী করে তুলতে বিলম্ব হয়। তাছাড়া প্রকল্প এলাকার অভ্যন্তরে নৌ-চলাচল ও বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়াও শুষ্ক মৌসুমে নদীতে উজানের প্রবাহ না থাকায় ভাটি হতে জোয়ারের সময় লবণাক্ত পানি প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ করে। লবণাক্ত পানি প্রবেশের ফলে উঠতি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষি জমিতে লোনা পানি প্রবেশের ফলে জমির উর্বরা শক্তি হ্রাস পায়।
প্রকল্প এলাকার মধুমতি, বাঘিয়ারকূল, শৈলদাহ ও ঘাঘর নদী এবং এমবিআর চ্যানেলের বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গনের ফলে রাস্তা-ঘাট, ফসলি জমি, বসত বাড়ি, মসজিদ-মন্দির, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি স্থাপনা হুমকির সম্মুখীন হয়। প্রকল্প এলাকায় ইতোপূর্বে নির্মিত বিভিন্ন পানি নিয়ন্ত্রণ অকাঠামো বোটপাস, রেগুলেটর, আউটলেট, ইনলেট ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা অকার্যকর হওয়ায় বন্যার পানি এবং লবণাক্ত পানি কৃষি জমিতে প্রবেশ করে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে থাকে। ইতিপূর্বে নির্মিত পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো সমূহ পুনর্বাসন করা প্রয়োজন।
গোপালগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রিফাত জামিল বলেছেন, বিগত ৪ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে মন্ত্রনালয়ের যাচাই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুনঃগঠিত ডিপিপি প্রধান প্রকৌশলী (পুর) পরিকল্পনার দপ্তর হতে ৮ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ে প্রেরন করা হয়। পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় ওই ডিপিপি ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরন করে। পরিকল্পনা কমিশনের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিপিপি অনুমোদন হলে কমিশন একনেকে পাঠাবে। একনেক সভায় পূর্ব গোপালগঞ্জ সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প অনুমোদন হলে পরবর্তী টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।
পাউবোর এই কর্মকর্তা আরো বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জেলার তিন উপজেলার জমির পানি নিষ্কাশন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও সেচ সুবিধা প্রদান করে কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা, লবণ পানির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা, নৌ-চলাচল ও ফসল পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
Design & Developed By: JM IT SOLUTION
Leave a Reply