কালের খবরঃ
১৫ আগস্ট ১৯৭৫, মহান মুক্তিযুদ্ধের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুনি ঘাতকদের হাতে নিমর্ম ভাবে নিহত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু মুজিবের নিজ জেলা গোপালগঞ্জ, টুঙ্গিপাড়া এই জনপদের মানুষেরা এ হত্যাকান্ডকে বিশ্বাস করতে চায় নি। রেডিওতে বারবার আমি মেজর ডালিম বলছি,“শেখ মুজিবকে স্ব পরিবারে হত্যা করা হয়েছে” এবং খুনি মোশতাকের রাস্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেয়া, সেই সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশ প্রধান, বিডিআর প্রধানসহ অন্যান্য সরকারী দপ্তরের প্রধানদের মোশতাক সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনের বিষয়টি রেডিওতে প্রচারিত হওয়ার পরে, মানুষের বিশ্বাসের জায়গাটি তচনছ হয়ে যায়। স্বজন হারানোর বেদনায় চারদিকে তখন এক গভীর নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সেদিনের সেই সকালে গোপালগঞ্জের গ্রাম থেকে শহর, বিল বাওড়ের মানুষেরা নির্বাক হয়ে যায়। ঘরে ঘরে শব্দহীন বোবাকান্না, মানুষের চোখের জল ছিল এই জনপদে মুজিব হত্যার প্রথম প্রতিবাদ।
১৬ আগস্ট আনুমানিক সকাল ১১টায় বঙ্গবন্ধু মুজিবের কফিন হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে আসা হয়। গোপালগঞ্জের তদানীন্তন এসডিপিও জনাব নুরুল আলম এবং ম্যাজিস্ট্রেট কাদের সাহেব এখন যেখানে ডিসির বাংলো, সেসময় ছিল এসডিও’র বাসভবন এবং এই বাসভবনের সামনে থেকেই স্পিড বোর্ডযোগে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন, সে সময় সরকারী বঙ্গবন্ধু কলেজ ছাত্র-ছাত্রী সংসদের জিএস বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব গোলাম মোস্তফা খান মিরাজ এবং ছাত্রনেতা কামরুজ্জামান বাদল তাদের সাথে স্পিডবোর্ডে টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার জন্য অনুনয় বিনয় করেন। সেসময়ে স্পিডবোর্ড ঘাট থেকেই এসডিপিও নুরুল আলম, ম্যাজিস্ট্রেট কাদের সাহেব তাদেরকে ধমক দিয়ে নিবৃত্ত করেন।
টুঙ্গিপাড়ায় হেলিকাপ্টারে থাকা ছত্রী সেনারা হেলিকপ্টারটি আকাশে থাকতেই মাটিতে নেমে আসেন এবং দ্রুত যুদ্ধাংদেহী পজিশন নিয়ে নেয়। তারা টুঙ্গিপাড়াসহ নিকটবর্তী গ্রাম থেকে আসা শোকাহত মানুষদেরকে অস্ত্রের মুখে এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করে। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায়, সেনারা ভীত এবং আতঙ্কগ্রস্থ ছিল। তারা দ্রুত লাশ দাফনের জন্য তড়িঘড়ি করছিল। এমনকি গোসল ছাড়াই জাতির জনকের দাফন করার চেষ্টা করেছিল। উপস্থিত টুঙ্গিপাড়ার শেখ আব্দুল মান্নান চাচা সহ কতিপয় সাহসী মানুষের প্রতিবাদের মুখে, তারা মাত্র ৩০ মিনিট সময় দেয় লাশ গোসল, জানাযা এবং দাফনের জন্য। কফিনটি এত শক্ত করে আটকানো ছিল যে, একজন কাঠমিস্ত্রিকে দ্রুত ডেকে এনে কফিনটি খুলতে হয়েছিল। টুঙ্গিপাড়া তখন ছিল একটি অজপাড়া গাঁ, রেড ক্রিসেট হাসপাতালকে কেন্দ্র করে কয়েকটি খুপরি দোকন ছিল। তারই একটি দোকান থেকে একটি ৫৭০ তীব্বত সাবান জোগাড় করা হয়, যা দিয়ে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে গোসল করানো হয়। রেড ক্রিসিন্টে হাসপাতালে থাকা রিলিফের মার্কিন থান বঙ্গবন্ধুর কাফন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সামরিক প্রহরায় সর্বাধিক ৩০ জন মানুষ বঙ্গবন্ধুর জানাযায় অংশগ্রহণ করতে সুযোগ দেয়া হয়। জানাযা শেষ বঙ্গবন্ধুকে বাবা মায়ের পাশে দাফন করা হয়। দাফনের পরে বঙ্গবন্ধুর কবরে অনেকদিন স্বসস্ত্র পুলিশ মোতায়েন ছিল, কাউকে কবর জিয়ারত বা দোয়া করার জন্য সেখানে যেতে দেয়া হত না।
বঙ্গবন্ধু হত্যা কান্ডের আকস্মিকতায় মুক্তিযুদ্বের পক্ষের রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীরা হতবিহ্বল এবং কিংকত্যর্ববিমূঢ় হয়ে পড়েন। তখন বাকশাল এবং জাতীয় ছাত্রলীগ গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল। গোপালগঞ্জের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকেই এ কারণে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন । যারা শহরে ছিলেন সেই সকল নেতৃবৃন্দ পুলিশি ধরপাকড় এড়ানোর জন্য গা ঢাকা দেন।
অনেকেই শহর ছেড়ে প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। ১৬ আগস্ট রাত আনুমানিক ৯ টার দিকে গোপালগঞ্জের জাতীয় ছাত্রলীগের তিনজন গুরুত্বপূর্ন নেতা, জনাব গোলাম মোস্তফা খান মিরাজ, এনায়েত হোসেন এবং অনিমেষ সরকার সুশিল শহরের মোহাস্মদপাড়স্থ আমাদের বাড়ীতে আসেন। আমাদের বাড়িটি তখন ছিল শহরের প্রান্তসীমায় এবং কোনো সড়ক যোগাযোগ ছিল না। নিরাপদ মনে করেই উল্লেখিত তিন নেতা আমাদের বাড়ীতে আত্মগোপন করেন। গোপালগঞ্জ শহরে গ্রেফতার অভিযানের প্রথমেই গ্রেফতার করা হয় সেইসময়কার গোপালগঞ্জের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগ সমর্থক বিজয় সিকদার বাবুকে। এরপেরই গ্রেফতার হন গোপালগঞ্জের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব কামরুল ইসলাম রইস। তাদেরকে বিশেষ নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে ফরিদপুর জেলে প্রেরণ করা হয়। দীর্ঘকাল তারা বিনাবিচারে ফরিদপুর জেলে বন্দী ছিলেন।
সংগঠিত প্রতিবাদ গড়ে তুলতে তদানীন্তন কতিপয় সাহসী তরুন নেতৃত্ব এবং কর্মীরা এরই মধ্যে সক্রিয় হতে শুরু করেন। তাদেরকে এই সময়ে সাহস এবং পরামর্শ দিয়ে পাশে ছিলেন জননেতা কমরুল ইসলাম রইস এবং কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সম্পাদক শওকত চৌধুরির মত মানুষেরা। কামরুল ইসলাম রইস সাহেব গ্রেফতার হওয়ার পরে ছাত্র নেতৃবৃন্দ আন্দোলন সংগ্রামের বিষয়ে সকল সময়ে শওকত চৌধুরির সাথে নিবিড় যোগাযোগ রাখতেন।
এরই মধ্যে জাতীয় ছাত্রলীগ ৪ নভেম্বর সারাদেশে মুজিব হত্যার প্রতিবাদে কর্মসূচী ঘোষণা করে। ঢাকা থেকে এই কর্মসূচী পালনের আহ্বান জানিয়ে প্রচারিত লিফলেটের একটি কপি তদানীন্তন কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা মুক্তিযোদ্ধা ইসমত কাদির গামা, প্রয়াত কাশিশ্বর দে’র পুত্র অনিল দে’র মাধ্যমে সরকারী বঙ্গবন্ধু কলেজের জিএস মিরাজের কাছে গোপনে প্রেরণ করেন। লিফলেটটি গোলাম মোস্তফা খান মিরাজ প্রয়াত শওকত চৌধুরীরকে দেখান এবং শওকত ভাই তাকে লিফলেটটি দুই হাজার কপি প্রিন্ট করার জন্য পরামর্শ দেন। তারা উভয় শলা পরামর্শ করে পরিচিত বেশ কয়েকজন প্রেস মালিকের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করেন এবং তাদের অনুরোধ জানান ছাপানোর ব্যবস্থা করার জন্য। একে একে সবাই বিষয়টি এড়িয়ে যান। সবশেষে কলেজ রোডস্থ গোকূল সাহা তার প্রিন্টিং প্রেসে লিফলেটটি ছাপাতে রাজি হন। ১লা নভেম্বর আনুমানিক রাত ১১ টার দিকে গোলাম মোস্তফা খান মিরাজ, মধ্যপাড়া গোকূল সাহার বাসায় গিয়ে তার কাছে লিফলেটটি রেখে আসেন এবং ২ নভেম্বর একই সময়ে পুনঃমুদ্রিত লিফলিটের দুই হাজার কপি জনাব মিরাজ এবং অনিমেষ সরকার সুশীল, তার বাসা থেকে সংগ্রহ করে গোপনীয় জায়গায় সংরক্ষণ করেন। ৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু কলেজের ছাত্রাবাসে, ৪ নভেম্বরের দেশব্যাপী কর্মসূচী গোপালগঞ্জে সফল করার জন্য জনাব মিরাজের নামে বরাদ্দকৃত কক্ষে এক গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন কমরেড মোহাস্মদ আবু হোসেন, এনায়েত হোসেন, কামরুজ্জামান বাদল, অনিমেষ সরকার সুশিল, মাহবুবুর রহমান জিন্নাহ। অসিত বরণ রায় খোকনের ভাষ্যমতে তিনিসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রকর্মী সভা অনুষ্ঠানের চারদিকে সতর্ক প্রহরায় ছিলেন যাতে গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন শাখার লোকজন আসলে নেতৃবৃন্দকে সর্তক করতে পারেন। সেখান থেকে রাত ১০ টার দিকে সভা শেষ করে নেতৃবৃন্দ তিনজন করে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে শহরে লিফলেট বিতরণের জন্য বের হয়ে যান। লিফলেট বিতরণের কৌশল হিসেবে গায়ে জড়ানো চাদরের নিচে অথবা জামার ভিতরে লিফলেট নিয়ে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নেতাকর্মীরা শহরের প্রায় প্রত্যেক বাসা-বাড়ীর দরজার নিচ দিয়ে গভীর রাতে লিফলেট বিতরণ করেন। অভিনব উপায়ে সেই রাতে কালীপূজার মেলায় গোপালগঞ্জে যাত্রা পালা মঞ্চস্থ হচ্ছিলো এবং একদল কর্মী প্যান্ডেলের ভিতরে প্রবেশ করে লিফলেট ছুড়ে দিয়ে গ্রেফতার এড়াতে দ্রুত প্যান্ডেল ত্যাগ করেন।
লিফলেটে ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ দিবস পালনের আহ্বান জানানো হয়েছিল। পরদিন খুব ভোরে এসডিপিও নুরুল আলম বঙ্গবন্ধু কলেজ হোস্টোলে প্রবেশ করে ছাত্রনেতা মিরাজকে কোন কর্মসূচী পালন থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ প্রদান করেন, ‘কোন কর্মসূচী আয়োজন করলে তার পরিনতি ভাল হবে না’ বলে শাসান। ভয় ভীতি উপেক্ষা করে নেতাকর্মীরা ভিন্ন ভিন্ন পথে কলেজের তিনটি প্রবেশ পথ ব্যবহার করে সকাল ৯.৩০ মিনিটের ভিতের, কলেজের পশ্চিম দক্ষিণে অবস্থিত শহীদ মিনার পাদদেশে জড় হতে থাকনে। ৪ নভেম্বরের এই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর একটি প্রতিকৃতি নিয়ে আসেন প্রয়াত শেখ শাহান। সমাবেশে সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভীতিকর পরিবেশের মধ্যেও ৪৩ জন সাহসী নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। সমাবেশে উপস্থিত কমরেড মোহাস্মদ আবু হোসেন, শেখ দেলোয়ার হোসেন দিলু, গোলাম মোস্তফা খান মিরাজ, এনায়েত হোসেন, অসিতবরণ রায় খোকন প্রমূখের সাথে প্রাবন্ধিক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় যাদের নাম জানতে পেরেছেন তারা হলেন- মাহবুবুর রহমান জেন্নাহ, রনজিৎ কুমার ভুলু, এস এম আক্কাস আলী, শফিকুল ইসলাম বাচ্চু, কামরুজ্জামান বাদল, সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম, মনিলাল বিশ্বাস, অনিমেষ সরকার সুশীল, তপন দাস, সমর দাস, গৌরঙ্গ চৌধুরী, রনজিৎ শীল, বুদ্ধিমন্ত বিশ্বাস, শহিদুল আলম, মোঃ ফিরোজ আহমেদ ডাব্লিউ, মোহাম্মদ আলী খান, হিরু ভুঁইয়া, আওলাদ হোসেন ভুঁইয়া, কাজী জিন্নাত আলী, মাহবুবুর রহমান খোকন, কোটালিপাড়ার মিলন ও সমরেশ বিশ্বাস। এছাড়া আর যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের নাম উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। তবে এই সমাবেশ আয়োজনে প্রয়াত জননেতা শওকত চৌধুরী গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন। নেতাকর্মীদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই একসাথে গ্রেফতার এড়ানোর কৌশল হিসেবে সমাবেশ চলাকালীন সময়ে, শওকত চৌধুরী নদীর পাড়ে কলেজের পশ্চিম পাশে খুব কাছেই একটি জ্বালানী কাঠ বিক্রির দোকেন বসে সমাবেশের দিকে নজর রাখছিলেন। এ বিষয়টি মোহাম্মদ আবু হোসেন ও গোলাম মোস্তফা খান মিরাজ নিশ্চিত করেছেন। সমাবেশে বঙ্গবন্ধু কলেজের জিএস বীর মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান আমেরিকা প্রবাসী গোলাম মোস্তফা খান মিরাজ, শেখ দেলোয়ার হোসেন দিলু আবেগময় বক্তব্য রাখার মূহুর্তে বিপুল সংখ্যক পুলিশের একটি দল সমাবেশটি ঘিরে ফেলে এবং এসআই আবুল হোসেন, গোলাম মোস্তফা খানের হাতে থাকা বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। প্রচন্ড প্রতিবাদে এবং সম্মিলিত প্রতিরোধে ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে পুলিশ ছবি ছিনিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে এসডিপিও নুরুল আলম উপস্থিত নেতাকর্মীদের গ্রেফতার আদেশ প্রদান করেন এবং সাবইকে বঙ্গবন্ধু কলেজের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত গেট দিয়ে পুলিশি নিরাপত্তায় পায়ে হাঁটিয়ে বর্তমান অগ্রণী ব্যাংকের সম্মুখ দিয়ে চৌরঙ্গী হয়ে থানায় নিয়ে যানা এবং তখন আনুমানিক সময় সকাল ১১ টা। নেতাকর্মীদেরকে থানার মাঠে উন্মুক্ত স্থানে সারাদিন বসিয়ে রাখা হয় এবং পুলিশ বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিতে থাকে। রাত আনুমানিক ৯ টার দিকে গোপালগঞ্জের শ্রদ্ধাভাজন আইনজীবী এবং রাজনীতিবিদদের প্রচেষ্টায় এসডিপিও নুরুল আলম এবং সিআই আব্দুর রহমানের সুপারিশে নেতাকর্মীদের মুক্তি দেয়া হয়।
গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু হত্যার একটি ব্যতিক্রমী দৃশ্যমান প্রতিবাদ করেছিলেন কোটিলীপাড়ার আওয়ামী লীগ নেতা সেকেন্দার মিঞা, কোটালিপাড়াবাসী তাকে আদর করে নেতাজি বলে সম্বোধন করতেন। নেতাজি সেকেন্দার মিঞা জাতির জনকের নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর শুনে মূলত মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর মাজারে বঙ্গবন্ধুর একটি প্রতিকৃতি বুকে নিয়ে সারাক্ষণ বিলাপ ও কান্না করতেন। হত্যাকারীদের বিচারের দাবীতে তিনি অনশনব্রত পালন করেছিলেন। এভাবেই এই মুজিবপ্রেমী পিতৃহত্যা শোকে, সব সময় প্রলাপ বকতেন। বেদনার সাথে উল্লেখ করতে হয় বর্তমান সময়ে কেউ আর নেতাজি সেকেন্দারকে স্মরণ করে না, এই জনপদের নতুন প্রজন্ম নেতাজি সেকেন্দারের নাম এবং অবদান সম্পর্কে কিছুই জানে না।
৪ নভেম্বর সমাবেশের পরে ৭ নভেম্বর সামরিক অভ্যুত্থানে জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, হয়রানী এবং সামরিক শাসনের প্রচন্ড রোষানলে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা আবারও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এরই মধ্যে ছাত্রনেতা মিরাজের নিকট ঢাকা মহানগর জাতীয় ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ নুরু একটি চিঠি নিয়ে আসেন, গোপালগঞ্জের আরেক সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ সিকদার। সে চিঠিতে সীমান্ত পার হয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বদলা নেয়ার জন্য গঠিত প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়। এই চিঠি পেয়ে জনাব মিরাজ সীমান্ত পার হয়ে ভারতে গিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদান করেন। ভারত থেকে জনাব মিরাজ গোপালগঞ্জের নির্ভরযোগ্য রাজনীতিক জননেতা শওকত চৌধুরীর নিকট একটি গোপনীয় চিঠি পাঠন। এই চিঠিতে তিনি শওকত ভাইকে বিশ্বস্ত নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে ভারতে যাওয়া এবং প্রতিরোধ যুদ্ধে শামিল হওয়ার অনুরোধ জানান।শওকত চৌধুরী চিঠিটি নিয়ে কমরেড মোহাম্মদ আবু হোসেনের সাথে দেখা করেন এবং তাকে চিঠিটা পড়তে দেন। মোহাস্মদ আবু হোসেনের ভাষ্যমতে চিঠিটি পড়ে তিনি তাৎক্ষনিক চিঠিটি নিরাপত্তার খাতিরে পুড়িয়ে ফেলতে অনুরোধ জানান। শওকত চৌধুরী মোহাম্মদ আবু হোসেনকে বলেন, আইনজীবী তৎকালীন ন্যাপ নেতা নুরুজ্জামান খোকনকে দেখিয়ে চিঠিটি বিনষ্ট করবেন। কিন্তু সেই সুযোগ তিনি আর পাননি। আবু হোসেন সাহেবের সাথে কথা শেষ করে নিজ বাসায় আসার পথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গোপালগঞ্জস্থ বাড়ীর সন্নিকটে পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনী তাকে চিঠিসহ গ্রেফতার করে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে ফরিদপুরে চালান করে দেয়া হয় এবং তার কাছ থেকে আরও তথ্য বের করার নামে রিমান্ডে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। এক বছর অধিককাল বিনা বিচারে জেলে থাকার পরে, হাইকোর্টে রিট আবেদন করে তিনি মুক্তি লাভ করেন। মূলত ভয়াবহ সেই শারিরীক নির্যাতনের কারণে গোপালগঞ্জের এই জনদরদি রাজনৈতিক নেতা, যিনি ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তিনি অকালে মৃত্যুবরণ করেন। শুধু তাই নয় গোপালগঞ্জের মহকুমা প্রশসকের কার্যালয় থেকে ১৯৭১ এর মার্চ মাসে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলক ছিলেন তিনি। সেদিনের সেই প্রতিবাদী নেতা কর্মীদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। কেউ কেউ প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন এবং আরও কিছু অভিমানী সাহসী যোদ্ধারা নিরবে নির্ভৃতে জীবনযাপন করছেন।আমরা কেউ তাদের কোন খোঁজখবর রাখি নি। নতুন প্রজন্মকে তাদের এই অবদান সম্পর্কে আমরা অবহিত করতে পারি নি। গোপালগঞ্জের এই ইতিহাসের নায়কদের মধ্যে অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শওকত চৌধুরীর নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আমরা আমাদের প্রকৃত বীরদের সম্মান এবং ভালবাসা দিতে পারি নি। ব্যর্থ হয়েছি তাদেরকে যাথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করতে, যা তাদের প্রাপ্য ছিল না।
লেখক: নাজমুল ইসলাম, সংস্কৃতিকর্মী
Design & Developed By: JM IT SOLUTION
Leave a Reply