মহাসিন আহমেদ রানাঃ
পররাষ্ট্রনীতি হলো কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের গৃহীত সেসব নীতি যা রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে সম্পাদন করে থাকে। একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ভর করে দেশটির নেতৃত্বের রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ওপর। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সফলতার জন্য শুধু শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করলেই হয় না, পররাষ্ট্রনীতির সফল বাস্তবায়নের জন্য থাকতে হয় শক্তিশালী নেতৃত্ব। নীতি ও নেতৃত্ব- এ দুইয়ের ওপরই নির্ভর করে কোনেও রাষ্ট্রের সাফল্য।বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানবিক সমাজের দর্শনে বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি স্বাধীনতার পর বিশ্বব্যাপী সেই দর্শন ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল দর্শন তিনি নির্ধারণ করেছিলেন- “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সাথে শত্রুতা নয়।” জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের স্বকীয় অস্তিত্বের কথা জানান দিয়েছিলেন।
বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় গত ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশ ‘ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা’ ঘোষণা করা হয়েছে। যেখানে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত পররাষ্ট্রনীতিরই প্রতিফলন দেখা যায়।এ রূপরেখায় ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। এই অঞ্চলকে ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী হবে, সেটাই মূলত তুলে ধরা হয়েছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা’ নামের নীতিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে রূপরেখাটি ঘোষণা করেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে বাইডেন প্রশাসন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বা আইপিএস কৌশল ঘোষণা করে। যেখানে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এক অবাধ, মুক্ত, সংযুক্ত, সমৃদ্ধ এবং সুরক্ষিত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কথা ঘোষণা করেন। বিশ্লেষকদের ধারণা, মূলত চীনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব ঠেকানোই এই কৌশলের মূল লক্ষ্য। যেসব দেশ মার্কিন এই কৌশলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে, তাদের বেশিরভাগের সাথে চীনের নানা বিষয়ে বিরোধ রয়েছে। বিভিন্ন দেশ এই কৌশলের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অবস্থানের ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে কিছু ঘোষণা করা হয়নি। বাংলাদেশকে কেন এই দেশগুলো ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ করতে চায়, সেটা বোঝা কঠিন নয়। যুক্তরাষ্ট্র, কোয়াডের অন্য সদস্য এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে ঢাকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এসব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ এ কৌশলের ভালো সহযোগী দেশ হতে পারে। ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ যার ফলে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার করার ব্যাপারে বরাবরই একটা চাপ ছিল। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের দিকে এগোলেও বাংলাদেশ চীনকেও আশ্বস্ত করতে চায়। ইন্দো প্যাসিফিকে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার করতেই রূপরেখা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বলছেন, ‘’বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে তাদের অবস্থান ঘোষণা করলো। আগেও ইন্টারনাল একটা বোঝাপড়া ছিল, এখন সেটা পাবলিক করা হলো। বাংলাদেশের যে ভারসাম্যমূলক অবস্থান, সেটা এর মাধ্যমে অনেক পরিষ্কার হবে।‘’
‘’আগে যেভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা হতো, এখন সেটা করা যাচ্ছে না। কারণ চীন-ভারত, চীন-যুক্তরাষ্ট্র বৈরিতা প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ যেহেতু বে অব বেঙ্গলের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়ে আছে, তারা মনে করছে, এখন নিজেদের অবস্থান জানানোর সময় এসেছে। সেজন্যই সরকার এখন এটা প্রকাশ করলো।
১৫টি লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি পরিচালিত হবে-
ক)ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখা,
খ)সমুদ্র বিষয়ক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার কাঠামো শক্তিশালী করা, অবাধ সামুদ্রিক চলাচল ও ভূখণ্ড বা জলসীমার ওপর দিয়ে আন্তঃ রাষ্ট্রীয় বিমান চলাচলের অধিকারের বিষয়ে পূর্ণ সমর্থন বজায় রাখা।
গ)আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ, শান্তিরক্ষা, সন্ত্রাস বিরোধী কার্যক্রমে সহযোগিতা ও সহায়তা
ঘ)আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমনে নীতি কাঠামো তৈরি এবং আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
ঙ)নারী, শান্তি ও নিরাপত্তায় আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার বজায়, আন্তঃ ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা করা,
চ)অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সমৃদ্ধি, সুষম ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখা,
ছ)ভৌত, প্রাতিষ্ঠানিক, জ্বালানি, ডিজিটাল উন্নয়ন, পণ্য, পরিষেবা, পুঁজি ও জনগণের সহজ চলাচল এবং প্রযুক্তির হস্তান্তরে কার্যক্রম অব্যাহত রাখা
জ)ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন ও অবাধ বাণিজ্য প্রবাহ রক্ষা
ঝ)মহাসাগর, সাগর ও সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ, ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা সুসংহত করা
ঞ)খাদ্য নিরাপত্তা, দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশ্নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ
ট)জলবায়ু পরিবর্তন, জীব বৈচিত্র্য হ্রাস, সামুদ্রিক দূষণ ও পরিবেশের ক্ষতিকর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা
ঠ)নবায়নযোগ্য খাতে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি
ড)ভবিষ্যৎ মহামারী রোধে সমন্বিত উদ্যোগ ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা জোরদারকরণ
ঢ) আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ
ণ)বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা ও উদ্ভাবন খাতে সহযোগিতা জোরদার করা।
Design & Developed By: JM IT SOLUTION
Leave a Reply