কালের খবরঃ লেখক নাজমুল ইসলাম!
১৯৬৯-৭০ এই সময়ে ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের কিছু স্মৃতি আমার মনে আছে, তখন আমি বাস করতাম আমার গ্রাম গিমাডাঙ্গায়। বর্তমানে টুঙ্গিপাড়া উপজেলার অন্তর্গত গোপালগঞ্জ জেলার একটি গ্রাম । আমাদের সেই গ্রাম আমার মনে পড়ে দুটি স্থায়ী শহীদ মিনার ছিল জিটি হাই স্কুলে আরেকটি আইডিয়াল হাই স্কুলে, প্রাইমারি স্কুলের শহীদ মিনার ছিলনা, আমরা যারা প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম তারা রাতের বেলায় ফুল সংগ্রহের জন্য যেতাম মূলত আমাদের প্রতিবেশী যারা সনাতন ধর্মাবলম্বী তাদের বাড়িতে তারাই বিশেষ করে গাঁদা ফুল এর গাছ লাগাত ,আমরা তাদেরকে বলা যায় না বলে আসলে চুরি করে ফুল নিয়ে আসতাম ।ভালোবাসার সেই ফুল দিয়ে আমরা মালা তৈরি করতাম আমাদের বড় বোনেরা এই কাজে আমাদের সহযোগিতা করতেন। আনন্দের সাথে আমাদের মা ,চাচীরা ও মাঝে মাঝে এই আয়োজনে শরীক হতেন । তখন শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া মুসলিম পরিবারের পক্ষ থেকে কোন নাজায়েজ কাজ এটা আমরা শুনিনি । ভোর বেলায় আমরা চলে যেতাম শহীদ মিনারে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। দুই কিলোমিটার পায়ে হেঁটে সবাই আমরা নগ্ন পদে থাকতাম আর সেই সময়ের একুশ এর আরেকটি বিষয় ছিল সেটি হল আমাদের থেকে যারা বড় নাইন টেন বা একাদশ দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়তো তারা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মিছিল বের করত সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে ২১ ছিল আমাদের প্রেরনা। এরকম একটি বিরাট মিছিলে আমি তখন হাফপ্যান্ট পরা চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। পাটগাতি বাজার ঘুরে আমরা ফিরছিলাম জিটি স্কুলের দিকে মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বীরমুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক পান্না বিশ্বাস। আমার মনে পড়ে একজন প্রভাবশালী মুসলিম লীগের নেতা মিছিলের পাশ দিয়ে জুতা পায়ে যাচ্ছিলেন পান্না মামা তাকে জুতা খুলে, হাতে করে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন। তখন সাধারণ মানুষ একুশে ফেব্রুয়ারিতে জুতা পায়ে বা স্যান্ডেল পায়ে সকালবেলায় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নগ্ন পদে হাঁটতেন। ১৯৭৫ সালের পরে যখন সামরিক শাসন আমলে ক্রমান্বয়ে বিশেষ করে আশির দশকে জিয়া এরশাদ এর সামরিক শাসন আমলে তারা অন্ধকার পছন্দ করতেন তাই শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে মধ্যরাতে আসা শুরু করে । আমি তখন জগন্নাথ কলেজে পড়ি ১৯৭৯-৮০ সালে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেতাম শ্রদ্ধা জানাতে তখন মধ্যরাতে শহীদ মিনারে যাওয়ার চল শুরু হয়েছে এবং আরেকটি বিষয়ে আমি তখন বিচলিত বোধ করতাম যখন ছাত্র সংগঠনগুলো শহীদ মিনারের উপরে তাদের নেতাদের ছবি টাঙ্গানোর জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতো এবং শহীদ মিনারের হাঙ্গামা
মারামারি লেগে যেত ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সেই জঘন্য রীতি চালু হওয়ার পর থেকে শহীদ মিনারের পবিত্রতা ক্ষুন্ন হতে শুরু করলো ।তখনও আমরা ছাত্ররা স্বৈরাচার বিরোধী সাময়িক শাসন আন্দোলনে একুশকে আমাদের প্রেরণা হিসেবে নিয়ে রাজপথে মিছিলে স্লোগানে আমরা উদ্দীপ্ত করে রাখতাম। তখনও ছাত্রসংগঠনগুলো বিশেষ করে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো শ্রদ্ধা জানানোর যে মালা বা ফুলের তোড়া বা ফুলের চাকতি নিজেরা তৈরি করত এরকম চাকতি তৈরি করতে করতে সন্ধ্যা হতে রাত দুটো তিনটে বেজে যেত আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম যেখানে ফুলের ডালা তৈরি করার জায়গা সেখানেই আমরা সেদিন বাড়িতে যেতাম না কারণ ভোরে আমরা যদি না আসতে পারি এই ভয়ে ।সকাল বেলায় আমরা ছেলেমেয়েরা একসাথে নগ্ন পদে প্রভাত ফেরীতে শহীদদের বন্দনা গীত গাইতাম ,দেশের মুক্তির জন্য স্লোগান দিতাম ,শোষণের বঞ্চনা থেকে মুক্তির গান গাইতাম ,কবিতা পড়তাম আমরা রবীন্দ্রনাথ,নজরুল, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান ,হাসান হাফিজুর রহমান আমাদের জসীমউদ্দীনকে ধারণ করতাম , আশির দশকে রুদ্র ,ইমতিয়াজ, মোহন রায়হানরা দরাজ গলায় আবৃত্তি করতেন । সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ,আমাদেরকে উদ্দীপ্ত করে বক্তৃতা করতেন আমাদের ছাত্র নেতারা যারা পরবর্তীকালে অনেকেই স্বৈরাচারের দোসর হয়েছেন কেউ কেউ এখনো মুক্তির পতাকা হাতে রাজপথে আছেন। কিন্তু সেই যে মধ্যরাতে তস্করের মতো শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার যে রীতি প্রচলিত হলো সেটি আর আমরা ফেরাতে পারলাম না ।আমরা স্বৈরাচারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মধ্যরাতে ফুল দেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলাম। আমরা রাতের অন্ধকারে শহীদরা যাতে আমাদেরকে না দেখে চুপিচুপি শ্রদ্ধা জানানোর রেওয়াজ তৈরি করলাম ।দিনের আলোয় যাতে আমরা যে আবেগের সাথে যে শ্রদ্ধা জানাতাম আমাদের শহীদের , সূর্যোদয়ের আলোর সাথে নতুন প্রজন্মের ভালোবাসা আপ্লুত হত হয়তো তা থেকেই আমরা তাদেরকে বঞ্চিত করলাম!
Design & Developed By: JM IT SOLUTION
Leave a Reply