কালের খবরঃ
গোপালগঞ্জে গরীবের বন্ধু, পরোপকারী ও সাদা মনের মানুষ হিসেবে পরিচিত ডাক্তার অসিত রঞ্জন দাস। সবাই তাকে এআর দাস নামে চেনেন। তিনি একজন সাদা মনের মানুষ হিসেবে সবার কাছে ইতোমধ্যে সমাদৃত। চাকরী থেকে অবসরে যাওয়ার পর বৃদ্ধ বয়সেও তিনি তাঁর মাসিক পেনশনের অধিকাংশ টাকা ব্যয় করে চলছেন সমাজের গরীব দুঃখী মানুষের জন্য। দরিদ্র পরিবারের ছেলে মেয়েদের লেখা পড়ার জন্য শিক্ষা বৃত্তি ও বয়স্কদের জন্য দরিদ্র ভাতা চালু করেছেন তিনি। এছাড়া প্রতিমাসে একদিন ফ্রি চিকিৎসার মাধ্যমে তাঁর গ্রামের বাড়ি কাশিয়ানী উপজেলার মহেশপুর ইউনিয়নের কাকদি গ্রামে সকল শ্রেণী পেশার মানুষদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। সবার সাথে তাঁর হাসিখুশি ব্যবহার। রোগীরা স্বাচ্ছন্দে তাঁর কাছে এসে খুলে বলেন মনের কথা। এছাড়া প্রতিদিন গোপালগঞ্জ শহরের কেন্দ্রীয় কালিবাড়ির সামনে নিজ বাড়িতে রোগী দেখেন। যে যা (ফি) দেন সেটাই গ্রহন করেন তিনি। ডাক্তার এআর দাস গ্রামে গরীবের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত। পৈতৃক বাড়িতে স্থাপন করেছেন “এ আর ফাউন্ডেশন” । বাবা অমূল্য রতন দাসের নামে এ আর শিশু একাডেমী এবং মা রমা রানী দাসের নামে “রমা পাঠাগার”। এই দুই প্রতিষ্ঠানের নামে কাশিয়ানীর বিভিন্ন গ্রামের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়া ৩০জন ছেলে মেয়েকে পাঠদান করানো হয়। এজন্য মাসিক বেতনে দুই জন শিক্ষিকা রাখা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজন পড়ুয়াদের মাসে পাঁচশত টাকা করে শিক্ষা বৃত্তি ও ১৪জন বৃদ্ধাকে পাঁচশত টাকা করে দরিদ্র ভাতা দিয়ে থাকেন।
এলাকাবাসী ও চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সঙ্গে আলাপ হলে তারা জানান, এই চিকিৎসক প্রশাসনের বড় বড় দায়িত্ব পালন করলেও নেই কোন চাকচিক্য বা ব্যক্তিগত গাড়ি। সাদামাটা জীবন যাপনই তাঁর যত আনন্দ। আন্তরিক ব্যবহার আর পরামর্শে মানুষকে রোগ মুক্ত করে তোলাই হচ্ছে তাঁর কাজ। রোগীর ভিজিট নেন স্বল্প। যাঁদের সামর্থ্য নেই তাঁদের দেখেন বিনামূল্যে। ওষুধ কোম্পানির স্যাম্পল পেলে তাও বিলিয়ে দেন গরিব রোগীদের। ব্যক্তি জীবনে তিনি একজন সৎ, পরোপকারী ও সাদা মনের মানুষ হিসেবে পরিচিত।
ডাক্তার এআর দাসের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমরা সাত ভাই ও এক বোন। মা বাবার চতুর্থ সন্তান আমি। আমার স্ত্রী কৃষি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে অবসরে আছেন। একমাত্র (কন্যা) সন্তান সে থাকে আমেরিকা। তাকে বিবাহ দেয়া হয়েছে। জামাই মেয়ে দুজনই আমেরিকায় চাকরী করেন।
আমি ১৯৭৩ সালে বাড়ির পাশে আলহাজ্ব এজি হাই স্কুল মাজড়া থেকে (স্টার মার্কস) নিয়ে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাশ করি। এইচএস সি পড়তে ভর্তি হই নড়াইল ভিক্টরিয়া কলেজে। ১৯৭৫ সালের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম স্ট্যান্ড করি। পরবর্তিতে এমবিবিএস পড়ার সুযোগ হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। সেখান থেকে ১৯৮২ সালে এমবিবিএস পাশ করি। রেজাল্ট ভালো করার সুবাধে ওই বছরই (১৯৮২) ডিসেম্বর মাসে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই আমার চাকরী হয়। সেখানে বেশ কিছুদিন চাকরীর পর চলে আসি নিজ জেলা গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে মেডিকেল অফিসার হিসেবে দীর্ঘদিন চাকরীর পর পদোন্নতি হয়ে আবাসিক মেডিকেল অফিসার এবং পরবর্তিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। পরে সুযোগ হয় গোপালগঞ্জ বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। এর পর প্রমোশন পেয়ে ফরিদপুর জেলার সিভিল সার্জন হিসেবে যোগদান করি। সেখানে তিন বছর চাকরীর পর পরিচালক হিসেবে যোগদেই ঝিনাইদাহ এর মেডিকেল এসিস্টেন ট্রেনিং স্কুলে ( ম্যাটস)। পরে ২০১৭ সালে অবসর গ্রহণ করি।
ডাক্তার অসিত রঞ্জন দাস আরো বলেন, বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তাঁর একার আয়ে চলতো আট ভাই বোনের লেখাপড়া ও সংসার খরচ। লেখাপড়া চালাতে আমাদের খুব বেগ পেতে হয়েছে। অনেক কষ্ট করে আমিসহ সব ভাই বোন লেখাপড়া করে সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করেছি। আমি ডাক্তার হয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব পালন করেছি। সব সময় গরীব দুঃখী মানুষের সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করেছি। ২০১০ সাল থেকে দরিদ্র পরিবারের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষা বৃত্তি শুরু করি। আর ২০১৭ সালে চাকুরী জীবন শেষ করে পেনশনের অর্থে দরিদ্র পরিবারের বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের দরিদ্র ভাতা দেয়া শুরু করেছি। বাবার নামে শিশু একাডেমি আর মায়ের নামে পাঠাগার স্থাপন করেছি। এই দুইটি প্রতিষ্ঠনের মাধ্যমে শিশুদের বিনামূল্যে পাঠদান, শিক্ষা বৃত্তি ও বৃদ্ধদের দরিদ্র ভাতা দিয়ে থাকি। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া শিখানোর জন্য মাসিক বেতনে দুইজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যা কিছু করছি সবই আমার পেনশন ভাতা থেকে। এছাড়া প্রতিমাসের শেষ শনিবার আমার গ্রামের বাড়ি কাশিয়ানী উপজেলার কাকদি গ্রামের পৈত্রিক ভিটায় এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষদের ফ্রি চিকিৎসা দিয়ে থাকি। আর শহরের চেম্বারে বসে রোগী দেখার সময় যে ফ্রি স্যাম্পল পেয়ে থাকি সেগুলো আবার দরিদ্র রোগীদের মাঝে বিলিয়ে দিই। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন এই ভাবে মানুষের জন্য কাজ করতে চাই।
সরেজমিনে, কাকদি গ্রামের পলি বেগম (৬০) বলেন, ডাক্তার বাবু আমারে বহুদিন ধরে চিকিৎসা দিয়ে আসছে। কোন টাকা পয়সা নেয়না। মাঝে মাঝে ওষুধ ও দিয়ে দেয়। এছাড়া প্রতিমাসে পাঁচশ টাকা করে পাই। তাই দিয়ে সাবান সোডা , চাল ডাল কিনি। এই রকম লোক পাওয়া দায়। আল্লাহ তার মঙ্গল করুক এই দোয়া করি।
একই গ্রামের ফাতেমা বেগম (৭০) , মর্জিনা বেগম (৬৫),হালিমা বেগম (৭০) বলেন, ৬ বছর আগের থেকে আমারে প্রতিমাসে পাঁচশ টাকা করে দিয়ে আসছে। এছাড়া মাঝে মধ্যে কম্বল, শাড়ী, চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়ে থাকে। ওনার মা বাবার মৃত্যু বার্ষিকীতে আমাদের খাবার দিয়ে থাকে এরকম দরদি লোক পাওয়া যায়না। আমারা তারে গরীবের বন্ধু বলে জানি। তিনি দীর্ঘজীবি হোক এই দোয়া করি।
শিক্ষা বৃত্তি পাওয়া তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ইমা খাতুন জানিয়েছে, আমি কাকদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে লেখাপড়া করি। বিকালে ডাক্তারের এ আর শিশু একাডেমি স্কুলে আসি। এখানে আমার কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নেয় না। মাস গেলে আরো পাঁচশত টাকা বৃত্তি পাই। এই টাকা দিয়ে খাতা, কলম, ব্যাগ ও বই কিনি। আমার মত আরো অনেকে বৃত্তি পেয়ে থাকে।
স্কুলের শিক্ষিকা তামান্না ইসলাম ও শেফালী দাস বলেন, স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমরা শিক্ষক হিসেবে এলাকার ছাত্র ছাত্রীদের লেখাপড়া করিয়ে যাচ্ছি। এর জন্য কোন ফি নেই না। মাঝে মধ্যে ছাত্রদের কলম খাতা ও বই দিয়ে থাকি। এর জন্য ডাক্তার এআরদাস আমাদের বেতন দিয়ে থাকেন। তার এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
গোপালগঞ্জ সুজনের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ অধিকারী বলেন, এটা একটা মহত উদ্যোগ। এই উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। শুধু এআর দাস নয় এই রকম উদ্যোগ অন্যসব চিকিৎসক বা অর্থবিত্তরা গ্রহণ করলে সমাজে কোন মানুষের সমস্যা থাকবেনা।
Design & Developed By: JM IT SOLUTION
Leave a Reply