মুকসুদপুর প্রতিনিধিঃ
ভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরানোর আশায় লিবিয়া হয়ে সমুদ্র পথে অবৈধভাবে ইতালি যাচ্ছিলেন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদি ইউনিয়নের চরপ্রসন্নদী গ্রামের তিন যুবক। ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবিতে প্রাণ হারায় তারা।মর্মান্তিক মৃত্যুর সংবাদে ৩ যুবকের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। সেই সাথে এলাকায় নেমেছে শোকের ছায়া।নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা ও প্রতিবেশীরা।
নিহতরা হলেন, মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদী ইউনিয়নের চরপ্রসন্নদী গ্রামের আব্দুল ওহাব খন্দকারের ছেলে সাত্তার খন্দকার (৪০), একই গ্রামের মেহেদী শেখের ছেলে আরাফসান ইসলাম আশিক (১৮) ও একই ইউনিয়নের মোল্লাদী গ্রামের প্রয়াত আব্দুল মজিদ শেখের ছেলে রফিকুল শেখ(৩২)।
নিহত সাত্তার খন্দকারের স্ত্রী লাবনী খন্দকার কান্না জড়িক কন্ঠে বলেন, অভাবের সংসার। টেকেরহাট বাজরে হাকিমের কাপড়ের দোকানে কর্মচারী চাকরী করতো। বেতন পেত ৮ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে তিন ছেলেমেয়ে সহ ৫ জনের সংসার চালানো খুবই কষ্ট হতো। তাই বাড়ি বন্ধক রেখে, এনজিও ও ব্যাংক থেকে ঋণ করে দালাল শহীদ শেখের মাধ্যমে ১৬ লক্ষ টাকা চুক্তিতে ইতালী পাঠাই।শহীদ দালাল আবার মাদুরীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের শ্ররামপুর গ্রামের জুলহাস দালালের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে নৌকায় বা ট্রলারে করে সাগরপারি দিয়ে ইতালী পাঠায়।বাড়ি থেকে রওনা হয় গেল বছরের ১৬ নভেম্বর। ‘লিবিয়া পৌঁছানোর পর আমার কাছ থেকে ৩ দফা টাকা নিয়েছে দালাল শাহীন শেখ চক্র।
তিনি বলেন,ইতালী পৌঁছে দিতে ১৬ লাখ টাকা দেওয়ার মৌখিক চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু দালাল চক্র আমার কাছ থেকে ২৬ লাখ টাকা নিয়েছে। এই টাকা আমি শতকরা ৮টাকা সুদে এলাকার মহাজনদের কাছ থেকে এনেছি। এখন স্বামীকেও হারালাম। সুদের টাকা কিভাবে পরিশোধ করবো আর ছেলে মেয়ে নিয়ে কিভাবে বাঁচবো বুঝে উঠতে পারছিনা।আমি দ্রুত আমার স্বামীর মরদেহ দেশে ফেরত আনার দাবি জানাচ্ছি।পাশাপশি দালাল চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। যাতে আর কোন স্ত্রী যেন বিধবা না হয় বা আর কোন ছেলে মেয়ে বাবা হারাপ না হয়।
ছোট বেলায় মা-বাবা হারা অপর যুবক রফিকুল শেখ (৩২) । বড় হয়েছে চাচা জয়নাল শেখ ও বড় ভাই মোঃ ফিরোজ শেখের কাছে। নিজের ভবিষ্যত গড়তে ও রড় ভাইকে সাহায্য করতে স্বপ্ন নিয়ে ভিটে-বাড়ি ও সহায় সম্বল বিক্রি করে দালালদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ১৭ লাখ টাকা।কিন্তু ইতালিতে যাওয়ার আগেই লিবিয়ার ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে রফিকুলের জীবন প্রদীপ নিভে যায়।রফিকুলের ভাই মোঃ ফিরোজ শেখ বলেন, আমার সাথে সর্ব শেষ কথা হয় ২২ জানুয়ারী। সেদিন রাতে আমার সাথে ফোনে কথা হলে রফিকুল আমাকে বলে ভাই আজ রাতে আমাকে গেম দিবে।দোয়া করিয়েন। আমি বেচে থাকতেও পারি আবার নাও পারি। বেঁচে থাকলে ৩/৪দিন পর কথা হবে।পরে জানতে পারলাম আমার ভাই বেঁচে নেই।শাহীন দালাল আমার ভাইকে প্রলোভন দিয়ে ইতালী যেতে উৎসাহিত করে। শুধু আমার ভাই নয় এলাকার যুবকদের লোভ দেখিয়ে মাথা নষ্ট করে দেয়। এরপর আর পোঠিয়ে পারিনা। এসব দালালদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিৎ।
একই পরিনতি বরণ করেছে চরপ্রসন্নদী গ্রামের কাঠমিস্ত্রী মেহেদী হাসানের আরাফসান ইসলাম আশিক। ছেলেকে ইতালি পাঠানোর জন্য ঋন ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার নিয়ে ১৭ লাখ টাকা তুলে দেন পাশ্ববর্তী শ্রীজিতপুর গ্রামের রকমান হাওলাদারের ছেলে বাবু হাওলাদারের হাতে। লিবিয়া যাওয়ার পর পরিবারের সদস্যদের সাথে ৩ থেকে ৪ বার কথা হয়। এরপর থেকে আশিকের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, আমার টাকাও গেল আর ছেলেকেও হারালাম।ছেলেটাকে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছি। কি পেলাম আমি।সরকারের কাছে দাবী করি আমার ছেলেকে যেন আমার কাছে ফিরেয়ে দেয়। এদিকে ছেলের মৃত্যুর খবর জানতে পরে বাকরুদ্ধ হয়েছে নিহত আরাফসান আশিকের মা খাদিজা বেগম। তিনি প্রথম সন্তানকে হারিয়ে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। কোন কথা বলছেন না।
জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ষষ্ঠীপদ রায় বলেন, এমন ঘটনা বারবার ঘটছে। গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুর জেলায় দালাল চক্রের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। এ চক্রের তালিকা সহ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা আইনশৃংখলা বাহিনী সহ নির্বাহী বিভাগের কাছে সুপারিশ করে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে তারা এ কাজ থেকে বিরত হবে বলে আমি মনে করি।
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, প্রশিক্ষণ নিয়ে বৈধভাবে ইতালি, জাপান, কোরিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার। আমরা এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। অবৈধভাবে ইতালি যেতে নিরুৎসায়িত করছি। দালালের খপ্পড়ে পড়ে অবৈধপথে ইতালি গমনকারীরা আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ করে না। এমনকি আমাদের সাথে পরামর্শও করে না। তাই এমন ঘটনা ঘটছে। এটি প্রতিহত করতে দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি ইতালী গামীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
এব্যাপারে মুকসুদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসনীন আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। সরকারি কোন দপ্তর থেকে আমাদের কোন কিছু জানায়নি। নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগও পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির পর লিবিয়ার ব্রেগা উপকূল থেকে এ পর্যন্ত ২০টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের সবাই বাংলাদেশী হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে লিবিয়ার রেড ক্রিসেন্ট।
Design & Developed By: JM IT SOLUTION
Leave a Reply