
কালের খবরঃ
পটভূমিঃ
খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলায় অবস্থিত ‘ভুতিয়ার’ বিল । বিলটি একসময় অভিশপ্ত হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০ বছরের উর্ধ্বে জলাবদ্ধতার কারণে এখানে বসবাসরত প্রায় ২৬টি গ্রামের অন্তত ৫০ হাজার মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। কৃষি বা অন্য কোনো কাজের সুযোগ ছিল না মানুষের। তবে, বিগত সরকারের দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও স্থানীয়দের দাবীর ফলস্বরূপ, ভুতিয়ার বিল অভিশপ্ততা কাটিয়ে ধীরে ধীরে নতুন জীবনে ফিরতে শুরু করেছে। যেখানে একসময় শুধুমাত্র পানির রাজত্ব ছিল, সেখানে এখন কৃষকরা ধান চাষসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করছেন। ভুতিয়ার বিল পূর্বের মতো কৃষি নির্ভর হয়ে উঠছে।
বিলের অবস্থানঃ
ভুতিয়ার বিলটি খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলা এবং নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে। বিলটিতে একসময় সরিষা, তিল, মসিনা, গুজি, মুগ, মুসুরি, খেসাড়ি, পিয়াজ, রসুন, ধনিয়া, রাধুনী, আউশ, আমন, পাট, আখসহ বিভিন্ন ফসল চাষাবাদের জন্য উপযোগী ছিল। ১৯৯৬ সাল থেকে জলাবদ্ধতা শুরু হয়। ২০০০ সালের মধ্যে বিলের অর্ধেক অংশ পানিতে তলিয়ে যায় এবং ২০০৫ সালে প্রায় ২ হাজার একর জমি স্থায়ী জলাবদ্ধতায় পরিণত হয়। এই অবস্থায় বিল পাড়ের মানুষের জীবিকার একমাত্র উৎস হয়ে দাড়ায় মাছ ধরা এবং শাপলা শামুক সংগ্রহ করা। তবে, জলাবদ্ধতার কারণে তারা দারিদ্র্যের শিকার হয়ে শহরের দিকে পাড়ি জমাতে শুরু করেন।
সরকারের উদ্যোগঃ
পরবর্তীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে ২০১৩ সালে ভুতিয়ার বিলের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ২৮১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পে আঠারোবাকী নদী, চিত্রা নদী, মিনাদারের খাল, আটলিয়া খাল, কাচিকাটা খাল, ইন্দুহাটি খাল, হাতিশুর খাল, নাচুনিয়া খাল, পাথলা খাল, সাচিয়াদাহ খাল, মহিষদিয়া সহ বিভিন্ন খাল খনন, নদী তীর সংরক্ষণ, স্লুইচ গেট নির্মাণসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়। এর ফলে বিলের উঁচু স্থানগুলো জেগে উঠেছে এবং স্থানীয় কৃষকরা এখন ইরি-বোরো ধান চাষ করতে পারছেন। আবার কেউ কেউ রোপা আউশ আমন ধানও চাষ করছে। তবে ইন্দুহাটি খালের মুখে স্লুইচ গেটের পিট( ভিত্তি) বিলের লেভেল থেকে উঁচু হওয়ায় পানি বের হতে বাধাগ্রস্থ হয়। এছাড়া মিনাদারের খালের আদমপুরে গ্রামে খালে স্থানীয়রা মাটির বাঁধ দেয়ায় বিলের পানি বের হতে দেরি হয়।

স্থানীয়দের অভিমতঃ
তেরখাদা ইউনিয়নের আদমপুর গ্রামের কৃষক নান্নু মুন্সী বলেন, “১৯৯৬ সাল থেকে আস্তে আস্তে বিলে পানি জমে থাকার দৃশ্য আমরা লক্ষ্য করি। তখন কিছু কিছু স্থান দেরিতে জাগতো। ২০০০ সালে এটা চোখে পড়ার মতো হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে পুরো বিল জলাবদ্ধতায় রূপ নেয়। প্রতিবছর জলাবদ্ধতার পরিধি বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে চাষাবাদ না করতে পেরে বিলবাসী বেকার হয়ে পড়ে। দেখা দেয় নিরব দুর্ভিক্ষ। বিলবাসী বর্ষা মৌসুমে বিলে জাল, বড়শি দিয়ে মাছ শিকার শুরু করে এবং শাপলা ও শামুক কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। কেউ কেউ আবার পেশা পরিবর্তন করে অন্যের জমি, কলকারখানায় শ্রমিকের কাজ, শহরে গিয়ে ভ্যান রিক্সা চালিয়ে বেঁচে আছেন। তবে এলাকাবাসী দীর্ঘ দিনের দাবীর ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১৩ সালে প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের ফলে এখন অনেক জায়গা জেগে উঠতে শুরু করেছে।”
তেরখাদা ইউনিয়নের জয়সোনা গ্রামের কৃষক আলমগীর ফকির বলেন, “এই বিলে আমার ২ বিঘা জমি রয়েছে। দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর জলাবদ্ধ অবস্থায় আছে। আমাদের রুটি-রুজির একমাত্র ভরসা এই জমি। চাষাবাদ করতে না পেরে বিল থেকে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করি। বিলের ঘাস দিয়ে গরু পুষি। ফসল হয় না, তাই এভাবেই আয়ের পথ বেছে নিয়েছি। তিনি আরো বলেন, ‘এখন বিল পাড়ে কিছু কিছু জমি জাগতে শুরু করেছে। ইরি-বোরো ধান চাষ হচ্ছে। পুরো বিলটি যাতে চাষযোগ্য হয়ে উঠে, সরকারের কাছে এই দাবী করি।

কোড়োরিয়া গ্রামের কৃষক বনমালি গাইন জানিয়েছেন, প্রায় ২০ বছর বিলের জমিতে কোনো চাষাবাদ হয় না। এখন কিছু কিছু জমি চাষের আওতায় এসেছে। আমরা যারা গরিব মানুষ আছি, তারা বিলের শাপলা তুলে হাট বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাই। দাম ভালো থাকায় প্রতিদিন ৪০০-৫০০ টাকা উপার্জন হয়। এছাড়া বিলের ঘাস দিয়ে গরু পালি(পুষি)।
পাতলা গ্রামের ইজিবাইক চালক মোঃ মিলন কাজী বলেন, বিলে আমাদের জমি আছে। কিছু জমি চাষ হয়, তবে বেশিরভাগ অংশ পানিতে নিমজ্জিত থাকে। আগে কৃষি কাজ করতাম, এখন ইজিবাইক চালাই। তিনি আরো বলেন, পাটগাতী খালের মুখে স্লুইচ গেটের মাধ্যমে আঠারোবাকী নদীর সাথে সংযোগ করে দিলে এবং বিল এলাকার চারপাশে যে খাল রয়েছে, তার কচুরিপানা পরিস্কার করা হলে, চাষ মৌসুমে বিলের পানি দ্রুত বের হবে। তাতে কৃষক সঠিক সময়ে চাষাবাদ করতে পারবে।
বিল এলাকার কোড়োরিয়া গ্রামের কৃষক তপন মালাকার, আবুল হাসান শেখ, সুশান্ত কুমার বিশ্বাস, পাতলা গ্রামের মিজান শেখ, ইন্দুহাটি গ্রামের সুবাস বিশ্বাস, সাচিয়াদাহ গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ, আদমপুর গ্রামের আব্দুর রহমান, কৃষক মোঃ ইকলাস ফকির, আব্দুল আলী মোল্লা, আল আমিন শেখের সাথে কথা হলে তারা একই সুরে বলেন, সরকারের চেষ্টায় আমরা বিলের অনেক অংশ ফিরে পেয়েছি। আর যেটুকু বাকী আছে, সে টুকু যেন দ্রুত করা হয়। তাহলে আমরা দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে বাঁচতে পারবো।
আদমপুর গ্রামের বৃদ্ধ সাহেব আলী মুন্সী বলেন, ভুতিয়ার বিলকে অনেকে পদ্মবিল হিসেবে জানে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভ্রমণপিপাসুরা পদ্মফুল দেখতে আসে। এলাকার যেসব বেকার ছেলে বা কৃষক রয়েছে, তারা তাদের নৌকায় করে ঘুরিয়ে দেখান। তাতে দিনে ভালো আয় হয়। এই আয় থাকে শ্রাবণ মাসের প্রথম থেকে আখের মাস পর্যন্ত।”একই এলাকার কৃষক ইলিয়াস মোল্যা জানান, পদ্মফুল যখন ফুটে, তখন শহরের মানুষ আসে। আবার গ্রামের কেউ কেউ ফুল তুলে বাজারে বিক্রি করে টাকা আয় করে।

কৃষি বিভাগের কথাঃ
তেরখাদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শিউলি মজুমদার বলেন, ভূতিয়ার বিলের প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমি রয়েছে। বিলের পানি নিষ্কাশনের জন্য বিলের সঙ্গে যুক্ত ১৪টি খাল ও ৮টি স্লুইচ গেট রয়েছে। বর্ষাকালে সম্পূর্ণ বিল জলমগ্ন থাকে। প্রায় ২০ বছর ধরে চলা জলাবদ্ধতার অবসান ঘটাতে বিএডিসির মাধ্যমে সরকার বিলের আশপাশের খালগুলো খনন করেছে এবং গত বছরও ৭টি খাল পুনঃ খনন করা হয়েছে। এই কারণে গত শুষ্ক মৌসুমে প্রায় অর্ধেক (৫০ শতাংশ) জমি চাষের উপযোগী হয়ে উঠেছে। বর্তমানে বিলের জমিতে ৬৮০ হেক্টর জমিতে আউশ, ৯২০ হেক্টরে আমন ধান, ৪৫ হেক্টরে পাট এবং ৪২ হেক্টরে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ চলছে।
তিনি ইন্দুহাটিসহ বেশ কয়েকটি স্লুইচ গেটের পিট (ভিত্তি) বিলের লেভেল থেকে উঁচু উল্লেখ করে বলেন, ছোটখাটো এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব হলে ভূতিয়ার বিল আবার স্বাভাবিকভাবে জেগে উঠবে, স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধ মুক্ত হবে এবং জমির মালিকরা তাদের জমিতে ফসল ফলিয়ে স্বাবলম্বী হবে। দেশী মাছের আধার হিসেবে খ্যাত বিলে আবার দেশী মাছের প্রজনন বৃদ্ধি পাবে।

প্রকৌশলীর কথাঃ
নড়াইল জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অভিজিৎ সাহা জানিয়েছেন, ভূতিয়ার বিলের জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত প্রকল্প ২০২১ সালে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে স্থায়ী জলাবদ্ধতা নিরসনে ‘টি আর এম’ (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) প্রকল্প গ্রহণের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। টিআরএম হচ্ছে জোয়ারের সময় নদী বা খাল থেকে পানি বিলে প্রবেশ করবে। ভাটায় পানি বের হওয়ার সময় পানির সঙ্গে থাকা সেডিমেন্ট (যেসব পানির সঙ্গে ভেসে বেড়ায়) যেমন বালু, পলি, কাদা জিমে বিল ধীরে ধীরে উঁচু হবে। আর বিলের স্বচ্ছ পানি যখন নদীতে বের হবে, তখন গেট বা নদীর মুখে জমে থাকা বালু বা পলি পানির স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে নদীকে গভীর করে। কিন্তু স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর কারণে সেটা করা সম্ভব হয়নি। বিলবাসী একমত হয়ে যদি সরকারের কাছে আবেদন করেন, তবে পুনরায় টিআরএম প্রকল্প তৈরি করে জমা দেওয়া হবে। আর সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে টিআরএম পদ্ধতি চালু হলে আশা করা যায়, বিলে জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হবে।
Design & Developed By: JM IT SOLUTION