বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৫১ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
গোপালগঞ্জে সার্ভেয়ারদের পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি, ভোগান্তীতে সেবা গ্রহীতারা দশম গ্রেডের দাবীতে কাশিয়ানীতে শিক্ষকদের মানববন্ধন ও স্বারকলিপি পেশ কাশিয়ানীতে পূর্ব শত্রুতার জেরে অন্ততঃ ২৫ টি বাড়ি-ঘরে গোপালগঞ্জে নানান আয়োজনে বসতি দিবস পালন গোপালগঞ্জে জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস পালিত গোপালগঞ্জে প্রতারণার শিকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১২০ বাসিন্দা স্বেচ্ছাসেবকদল নেতা দিদার হত্যা মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা তৌফিক গ্রেপ্তার বশেমুরবিপ্রবি’তে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন গোপালগঞ্জে ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেল কলেজ ছাত্রের, আহত ২ স্বেচ্ছাসেবকদল নেতা দিদার হত্যা মামলায় চার আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার

৫৭০সাবান দিয়ে বঙ্গবন্ধুর লাশের গোসল! দাফন হয় তাচ্ছিল ভাবে

Reporter Name
  • Update Time : বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩, ২.৫৬ পিএম
  • ১৮০ Time View

কালের খবরঃ

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মে ছিলেন বাঙ্গালির স্বপ্নদ্রষ্টা ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।এখানে বেড়ে ওঠার সুবাদে শৈশব আর কৈশরের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন তিনি। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটের আঘাতে নির্মমভাবে জীবন দিতে হয় এই নেতাকে। লাশ টুঙ্গিপাড়ায় আনার পর সেদিন যারা দাফন কাফনে বা জানাযায় অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে বেঁচে থাকা বয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানালেন দফনের কাফনের সেদিনকার হৃদয়স্পর্শী  কথা।

কফিন খোলাঃআইয়ুব আলী মিস্ত্রি। পিতা আব্দুল হালিম শেখ। তখন তার বয়স সতের। বাপবেটা একসঙ্গে কাঠ মিস্ত্রির কাজ করতেন। মিস্ত্রি কাজ করে জীবন জীবীকা ছিল তাদের। এখনও মিস্ত্রি কাজ করে সংসার চলে এই আইয়ুব আলী শেখের।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেদিন বাবা ও ছেলে মিলে কাজ করছিলাম টুঙ্গিপাড়া উপজেলা পুলিশ ব্যারাকে। বঙ্গবন্ধুর কফিন খোলা নিয়ে (লাশের বাক্স) কথা হয় মিস্ত্রি আইয়ুব আলীর সঙ্গে।

তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আনুমানিক দুপুর আড়াইটা। এ সময় একটা হেলিকপ্টার এসে নামলো কেড়াইলকোপা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। সেখান থেকে লাশের একটি কাঠের বাক্স ঘারে শেখ সায়েরা খাতুন রেডক্রস হাসপাতালের কিছু কর্মচারী সেনা বাহিনীর সদস্যদের পাহারায় নিয়ে এলো বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর মা-বাবার কবরের পাশে রাখল লাশের বাক্স। বাক্সে পেরেক (লোহার বড় পিন)  খুলতে না পারায় ডাক পড়ে আমার বাবা আব্দুল হালিম শেখের। বাবা আমাকে বলেন হাতুড়ি,পিন উঠানো শাবল ও বাটালি নিয়ে ওনার সঙ্গে আসতে। আমি বাবার সাথে তাড়িঘড়ি করে  এসব অস্ত্রপাতি নিয়ে পিছু পিছু আসলাম। বাক্সটিতে বহু পেরেক মারা ছিল। আমি আর আমার আব্বা খুব কষ্ট করে পেরেক গুলো খুলে দিলাম। বাক্সের ডালা খুলে দেখি বঙ্গবন্ধুকে একটি সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছে। কাপড়ের নিচে বরফ। চাকা চাকা বরফ চাপায় রয়েছে বঙ্গবন্ধুর লাশ। মাথাটি কাতকরা অবস্থায়। বঙ্গবন্ধুর গায়ে ছিল সাদা রং এর গেঞ্জি ও চেক লুঙ্গি। লাশের নিচে কাঠের গুড়ি। বরফ গলা পানিতে সব ভিজে কাপড়ে লাল ছাপ ছাপ দাগ হয়ে গেছে। বরফ সরানোর পর দেখলাম বঙ্গবন্ধুর বুকে ১৫/১৬টি গুলির ছিদ্র। বুকটা ঝাঝড়া। হাতের তালু গুলিতে ফুটো হয়ে গেছে।এই দৃশ্য দেখে আমার মাথা ঘুল্লি খায়। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুদের ধানের গোলাঘরে ঢেস দিয়ে দাড়িয়ে থাকলাম বেশ কিছু সময়। বাক্স খোলার পর আর্মিরা জাতির পিতার লাশ গোসল করানোর জন্য খুবই ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেল। আর  হুংকার দিতে থাকলো পাঁচ মিনিটের মধ্যে গোসলের কাজ সারতে। আমরা যারা ছিলাম তারা সবাই ভয়ে ভয়ে কাজ করছিলাম। পরে বঙ্গবন্ধুকে গোসল করানো হল। গোসলের পর জানাযা শেষে কবর দিয়ে সবাইকে তড়িঘড়ি করে বের করে দেয়া হলো। আমি আর আব্বা জানাযায় শরীক হওয়ার পর বাড়ি চলে এলাম।

গোসল করানোঃজাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির পাশে বাড়ি কাজী ইদ্রিস আলীর। বঙ্গবন্ধুকে গোসল করিয়েছিলেন এই মানুষটি। তখনকার রেডক্রস হাসপাতালের বাবুর্চি হিসেবে চাকরী করতে এই ইদ্রিস আলী কাজী। কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি বলেন, লাশ আসার আগে টুঙ্গিপাড়া থানার পুলিশ বঙ্গবন্ধুর বাড়িসহ আশপাশ এলাকা ঘিরে ফেলে। এই ভয়ে এলাকার লোকজন সব ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। আমরা যারা রেডক্রস হাসপাতালে চাকরি করতাম তারা হাসপাতালের মধ্যে ছিলাম। তখন আমাদের ডাক্তার ছিল আক্তরুজ্জামান সাহেব। তার কাছে আসলেন পুলিশ ফাঁড়ির অফিসার। উনি এসে বললেন বঙ্গবন্ধুর লাশ আসছে ডাক্তার সাহেব আপনি আপনার স্টাফদের আমার সাথে দেন। ডাক্তার সাহেব আমাদের ওনার সঙ্গে যেতে বলায় একজন দারোগা আমাদের টুঙ্গিপাড়ার ডাকবাংলায় নিয়ে রাখলো। দুপুর আড়াইটার দিকে হেলিকপ্টার টুঙ্গিপাড়ার আকাশে দেখা গেল। হেলিকপ্টার যখন মাটিতে নামলো তখন হেলিকপ্টার থেকে মেলেটারিরা লাফ দিয়ে দিয়ে নেমে পজিশনে চলে গেল। পরে বাঁশিতে ফু দেয়ার সাথে সাথে মিলিটারিরা হেলিকপ্টারে রাখা লাশের কফিনের কাছে এসে দাড়ালো। পরে মিলিটারিরা আমাদের ওখানে নিয়ে বললো এই ধর। আমরা ৮/১০ জন কফিনের বাক্স জাগাতে (উচুকরা) পারিনা। তখন ওরাও ধরলো। সবাই মিলে ঘারে করে লাশের বাক্স নিয়ে আসলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ঘরে সামনে। তখন বাক্স খোলার জন্য কিছু না পেয়ে ডেকে আনা হলো আব্দুল হালিম মিস্ত্রি ও তার ছেলেকে। তারা বাক্স খুলে দিল। বাক্স খোলার পর দেখলাম বঙ্গবন্ধুর লাশ সাদা কাপড় দিয়ে ডাকা। আমি কাপড়টি সরানোর পর দেখলাম বঙ্গবন্ধুর মুখ ডান দিকে কাত করা। চশমাটি ভেঙ্গে বেধে আছে। লুঙ্গি ও গেঞ্জি পড়া। সেন্ডেল বাক্সের মধ্যে লম্বা হয়ে আছে। আমি এগুলো সরাতে থাকলাম। আর দুই তিনজনকে পানি আনতে বললাম। গোসল করাতে সাবানের দরকার। সাবান পাবো কোথায় । তখন আশরাফ আলীর দোকান খুলে একখানা ৫৭০ সাবান আনা হল। দাম ছিল ছয়আনা। গোসল করাতে দেরি হচ্ছিল বলে আর্মিরা আমাদের বন্ধুকের বাট দিয়ে মারতে আসে আর বলে তারাতাড়ি কর। সময় কম। আমরা ৬/৭জন মিলে তড়িঘড়ি করে গোসল দিলাম। গোসল শেষে  কাফনের কাপড় দরকার। তা পাবে কোথায়। দোকানপাট সব বন্ধ। তখন আবার রেডক্রস হাসপাতালে গেল। সেখান থেকে রোগীদের জন্য ছিল লাল পাড়ের সাদা শাড়ী।সেই শাড়ী এনে পাড় ছিড়ে কাফনের কাপড় বানানো হল। এখন জানাযার পালা। জানাযা পড়াবে কে। জানাযা পড়ানোর জন্য কেই নাই। ডেকে আনা হল শেখ আব্দুল হালিম মৌলভীসহ বেশ কয়েকজনকে। তখন মৌলভী সাহেব সম্মিলত ভাবে আমাদের হাতে গোনা ৩০/৩৫ জনকে নিয়ে জানাযা পড়ালেন। পরে আমরা ওই কয়জন বঙ্গবন্ধুকে মাটি দিয়ে বাড়ি চলে গেলাম।

 জানাযাঃটুঙ্গিপাড়ার গিমাডাঙ্গা গ্রামের গোলাপ মোল্লা । তখন তার বয়স ২৪/২৫। কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি বলেন,বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর লাশ যখন আনা হয় তখন দেখার জন্য দৌড় দিয়ে ঢুকতে যাই। আমাকে বাধা দেয় পুলিশ। তখন আমার বয়স ২৪/২৫। এসময় আমার পাশদিয়ে আরেকজন ঢুকতে গেলে পুলিশ  তাকে বাধা দিতে যায়। আমি ওই ফাঁকে ভিতরে চলে যাই এবং জানাযার কাতারে দাড়াই। পরে কষ্টকরে মাটি দেই। বের হওয়ার সময় ওই পুলিশ আমাকে একটা চরমারে। চরখেয়ে আমি দৌড় দিয়ে চলে আসি। তিনি আরো বলেন,সেনাবাহিনীর ভয়ে শেখ পরিবার বা এলাকাবাসী  জানাযায় আসতে পারেনি। সে সময় শেখ পরিবারের লোকজন আত্মগোপনে ছিল। বঙ্গবন্ধুর এক চাচীকে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করা হয়। হাতে গোনা কয়েকজন  মুরব্বি জানাযায় অংশ নিয়েছিল।

এলাকাবাসীর কথাঃগোপালগঞ্জ উদীচীর সভাপতি নাজমুল ইসলাম তার প্রতিকৃয়ায় বলেন, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় জম্মগ্রহণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । মা- বাবা তাঁকে আদর করে খোকা বলে ডাকতেন। এলাকার ছোট, বড় ও গরীব দুঃখী মানুষের সাথে হেসে খেলে দিন কাটিয়েছেন তিনি। এই নেতাকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ঢাকা থেকে লাশ আনা হয় হেলিকপ্টার যোগে। হেলিকপ্টার আসার সাথে সাথে হাজার হাজার মানুষ আসতে থাকে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে। কিন্তু সে দিন সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা কোন মানুষকে কাছে আসতে দেয়নি। অংশ নিতে দেয়নি তাঁর জানাযায়। মাত্র ৩০ / ৩৫জন মানুষ নিয়ে অনেকটা দায়সারা ভাবে সম্পন্ন করা হয় দাফন কাফন ও জানাযা। সেদিন একজন রাষ্ট্রনায়কে গোসল করানো হয় ৫৭০ সাবান দিয়ে। কাফনের কাপড় পরানো হয় হাসপাতালের  রোগীদের জন্য ব্যবহৃত থান কাপড় দিয়ে। দাফন করা হয় অনেকটা তুচ্ছ তাচ্ছিল ও দাসারা ভাবে। এই দিনটি আসলে এলাকার মানুষের মধ্যে সেই শোকব্যথা জাগ্রত হয়।

 

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

Advertise

Ads

Address

Office : Sheikh Fazlul Haque Moni Stadium (2nd floor), Gopalganj-8100 Mobile: 01712235167, Email: kalerkhabor24.com@gmail.com
© All rights reserved 2022

Design & Developed By: JM IT SOLUTION