শিল্পী সাহা,গোপালগঞ্জঃ
একদিন মীনা আম গাছে চড়ে একটি পাকা আম পাড়লেও বড় টুকরোটা মা রাজুকে দিয়েছিলেন। রাতে খাবার দেওয়ার সময়ও মা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করলেন। কারণ রাজু ও মা মীনার ঘরের কাজকে কাজই মনে করত না। পরবর্তীতে রাজু ও মীনা সিদ্ধান্ত নিলো যে রাজু মীনার কাজ করবে এবং মীনা রাজুর কাজ করবে। মীনা তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছিল যে ঘরের কাজগুলো খুব একটা সহজ নয়। তারপর একদিন রাজু গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে সমান দুইভাগ করে মীনাকে দিয়েছিল এবং নিজে খেয়েছিল।
মীনার সাথে উপরোক্ত বৈষম্যটি কন্যাশিশুদের নিত্যকার সঙ্গী। বর্তমানে আমরা করোনা মহামারির ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এই মহামারি নিয়ে আমরা সকলেই খুব উদ্বিগ্ন। কিন্তু আমাদের সমাজ যে এই মহামারির চেয়েও বড় মহামারির দ্বারা আক্রান্ত রয়েছে, এ বিষয়ে অনেকেই সচেতন নয়। আমাদের সমাজ বৈষম্যের মহামারিতে আক্রান্ত। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষবাষ্পের মতো মিশে রয়েছে বৈষম্য। একে করোনার চেয়েও বড় মহামারি বলার কারণ- করোনা ভাইরাস যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও ভ্যাকসিনের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়। কিন্তু সমাজ থেকে বৈষম্য দূরীকরণের জন্য যে সচেতন মানসিকতা প্রয়োজন, তা অনেকে বুঝেও বহন করতে চায় না। ফলে বৈষম্যের মহামারি দীর্ঘমেয়াদি রূপলাভ করেছে। আজ কিছু পরিবারে একটি শিশুকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয় শুধুমাত্র এই কারণে যে সে কন্যা সন্তান। স্বভাবতই একটি শিশু পরিবারের আদর-ভালোবাসা-স্নেহের মাঝে বেড়ে ওঠে। তার মা-বাবাই তার কাছে সব। পরিবার হলো শিশুর সামাজিকীকরণের প্রথম এবং সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। কিন্তু এই পরিবারই যখন কোনো কন্যাশিশুকে বোঝাস্বরূপ মনে করে, তখন পরিবারের সদস্যদের মনুষ্যত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অনেকে এটা বিশ্বাসই করেন না যে নারীরা ভবিষ্যতে কিছু করতে পারে। তাই তারা কন্যাদের অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয় যা আইনত দণ্ডনীয়। আমাদের দেশে কন্যাশিশুদের অধিকার রক্ষার জন্য অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন: বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৮ এবং যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮ পাশ করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ২২শে জুলাই লন্ডন গার্লস সামিটে প্রদত্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন এবং বাল্যবিবাহ নিরোধকল্পে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৮-২০৩০) অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে সকল শিশুর বাল্যবিবাহ নির্মূল এবং ১৫-১৮ বছর বয়সের মধ্যে বাল্যবিবাহের হার এক তৃতীয়াংশে হ্রাস এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণ নির্মূল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই সুফল বয়ে আনতে পারবে না যদি জনগণ সচেতন না হয়।
আমরা সকলেই জানি,”শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ।” অর্থাৎ, শিশুরাই ভবিষ্যতে দেশের উন্নতির হাল ধরবে। এখানে কিন্তু ছেলে বা মেয়ে না বলে শুধু শিশু বলা হয়েছে। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন,”আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে একটি শিক্ষিত জাতি দিব।” আজকের কন্যাশিশুরা শিক্ষা গ্রহণ করলে, ভবিষ্যতে তারা একজন শিক্ষিত মা হিসেবে সন্তানদের সুনাগরিক তৈরি করতে পারবে। ছেলে হোক বা মেয়ে প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। তবে এজন্য দরকার তাদের প্রত্যেকের অধিকার নিশ্চিত করা। বর্তমানে সমাজ যদি কন্যাশিশুদের সকল অধিকার নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে ঐ কন্যাশিশুরাই ভবিষ্যতে সমাজের সকলের অধিকার নিশ্চিতের দায়িত্ব নিতে পারবে। তাই বর্তমানের বৈষম্যের মহামারি থেকে পরিত্রাণ পেয়ে উন্নত রাষ্ট্র গঠনের নিমিত্তে সকলকে সচেতনতার ধ্বজা ধরে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে।
Design & Developed By: JM IT SOLUTION
Leave a Reply